মোঃ মোক্তার হোসাইন- সোনারগাঁও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্ষা মৌসুমে যখন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও চিকনগুনিয়ার মতো রোগের প্রকোপ বাড়ছে, তখন সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভেতরে ও আশপাশে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি। একদিকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা রোগীদের ভোগান্তি, অন্যদিকে হাসপাতালের চারপাশে অপরিচ্ছন্নতা, জলাবদ্ধতা, জঙ্গল ও বর্জ্যের স্তুপ—সব মিলিয়ে এটি যেন এক মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাসপাতাল প্রাঙ্গণে জলাবদ্ধতা একটি নিয়মিত দৃশ্য। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের কোনো সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় হাসপাতালের ভেতরেই সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট পুকুর। এই জমে থাকা পানিতে জন্ম নিচ্ছে প্রাণঘাতী এডিস মশা, যার মাধ্যমে ছড়ায় ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার মতো ভয়াবহ রোগ।
হাসপাতালের চারপাশ এখন পরিণত হয়েছে এক অযত্ন-অবহেলায় বেড়ে ওঠা ঝোপঝাড়ে ভরা জঙ্গলে। যেখানে পড়ে আছে ডাবের খোসা, ব্যবহৃত বোতল, প্লাস্টিক, পলিথিন ও কাচ জাতীয় দ্রব্য। এইসব স্থানে জন্ম নিচ্ছে বিষাক্ত পোকামাকড় ও রোগজীবাণু।
হাসপাতালের প্রধান ফটকেই ঢেকে গেছে ‘সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’ লেখাটি—একটি বিশাল গাছের ডালপালায়। এতে নতুন রোগীরা ঠিকমতো হাসপাতালের অবস্থানও বুঝতে পারছেন না।
সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র হলো—হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে কুকুর। শুধু ঘোরা নয়, কুকুরগুলো দিনের বেশির ভাগ সময় হাসপাতালের করিডোরেই শুয়ে, বসে কিংবা ঘুমিয়ে কাটায়। রোগীদের ভেতরে একধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করছে এই দৃশ্য।
রোগীদের ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ টয়লেটগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বেশিরভাগ টয়লেটের ফ্লাশ অকেজো, অনেক টয়লেটের দরজায় খিল নেই, এমনকি কিছু দরজায় ছিদ্রও রয়েছে, যা ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ করছে। দুর্গন্ধে টয়লেটের আশপাশ দিয়েও যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
হাসপাতালের নতুন ভবনের ছাদে দেখা গেছে ব্যবহারিত ব্যান্ডেজ, দুর্গন্ধময় ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট ময়লা। এটি শুধু পরিবেশ দূষণই করছে না, বরং জীবাণুর সংক্রমণের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও (রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার) ডাঃ জামিউর রহমান দায় এড়িয়ে বলেন, ” আমি সদ্য যোগদান করেছি আর আমাদের কোনো তথ্য ও বক্তব্য দেয়ার অনুমতি নেই। এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বলতে পারবেন।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শারমিন আহমেদ তিথি বলেন—
“বিষয়টি আমরা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়েছি। বর্ষার কারণে হাসপাতাল চত্বরে কিছু জায়গায় সাময়িকভাবে পানি জমেছে এবং ঝোপঝাড় বেড়েছে—যা ডেঙ্গুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। আমরা ইতোমধ্যে পৌরসভা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক প্রচারণাও চালানো হবে।
হাসপাতালে অবাঞ্ছিত পশুর (যেমন: কুকুর) প্রবেশ রোধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। টয়লেটগুলোর সংস্কার ও ডাস্টবিন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এটা ঠিক যে, জনবল ও বাজেট সংকটের কারণে কিছু সমস্যা মোকাবিলা করতে সময় লাগছে, তবে আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি যেন রোগীরা নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশে চিকিৎসা সেবা পেতে পারেন।”
সেবা নিতে আসা আসাদ বলেন, “সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সারা উপজেলার মানুষদের জন্য একমাত্র সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র। সেখানে যদি এমন অব্যবস্থা বিরাজ করে, তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ জরুরি।”
মানুষের প্রাণ রক্ষার স্থানে যদি অসচেতনতা ও অব্যবস্থাপনা থাকে, তবে তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে বাধ্য। এখনই সময় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের—নইলে স্বাস্থ্যসেবার বদলে রোগ-সংক্রমণের কেন্দ্র হয়ে উঠবে হাসপাতাল।