মোঃ মোক্তার হোসাইন-সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি
সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ময়লার স্তূপ।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন শত শত রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। অথচ এখানেই হাসপাতালের সামনে খোলা জায়গায় রক্তমাখা টেস্ট টিউব, কাঁচের ইনজেকশন শিশি, কফ-স্পার্মযুক্ত স্যাম্পল বোতল, ভাঙা সিরিঞ্জ ও গজ-প্যাডের স্তূপ পড়ে থাকে, নেই কোনো ডাম্পিং পিট, নেই ‘বায়োহ্যাজার্ড’ সতর্কচিহ্ন।
স্থানীয়রা জানান, হাসপাতাল ভবনের সামনে এমন ময়লার স্তূপের পাশ দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে পায়ে কাঁচ লেগে আহত হয়েছেন অনেকেই। তাছাড়া, ব্লাড, কফ সহ নানান টেস্ট টিউবগুলো পায়ের তলায় চাপা পড়ে ফেটে যায় ফলে,আশপাশে পালিত মুরগী ও ঘুরে বেড়ানো কুকুর প্রতিদিন এই বর্জ্যের মধ্যে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। আক্রান্ত স্থানের পাশে রয়েছে একটি বড় পুকুর—যেটি মসজিদের মুসল্লীরা অযুর জন্য ব্যবহার করে, এলাকাবাসীর গোসলের জন্য এবং রান্না ও ঘরের কাজের পানির উৎস হিসেব এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ব্যবহার করে আসছে।
বর্ষাকালে বিষয়টি আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে রক্ত, কফ বা ইনজেকশনের অবশিষ্টাংশ পুকুরের পানি দূষিত করছে, যা প্রতিদিন মানবদেহে ঢুকে পড়ছে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে—“এই ধরনের মেডিকেল বর্জ্যে থাকে হেপাটাইটিস বি ও সি, টিবি, এইচআইভি-এর জীবাণু, যা পানিতে ৩-৭ দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। এই পুকুর থেকে গোসল কিংবা রান্নার মাধ্যমে সহজেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
পাশাপাশি স্থানীয় পালিত মুরগী ও রাস্তার কুকুর প্রতিদিন এই বর্জ্যের মধ্যে পা দিয়ে ঘাঁটে, এমনকি স্যাম্পল বা সিরিঞ্জ, পোকামাকড় খাবারের সাথে খেয়ে ফেলে। এরপর সেই মুরগী বাজারে বিক্রি হলে তা বিষাক্ত খাদ্য হিসেবে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে—“মেডিকেল বর্জ্য খাওয়া মুরগী মানুষের জন্য সালমোনেলা, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ও ফুড পয়জনিং ছড়াতে পারে। কুকুরের শরীরে গেলে জলাতঙ্কসহ অন্ত্রনালির মারাত্মক ইনফেকশন হয়।”
স্থানীয় বাসিন্দা নাসরিন আক্তার বলেন— “পুকুরের পানি দিয়ে আগে রান্না করতাম, কাপড়ও ধুতাম। এখন বুঝতে পারছি কত ভয়ানক জায়গায় পড়ে আছি।”
কোয়ার্টারের নার্স, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বলেন—“আমার ছেলে বিকেলে খেলতে গিয়ে হাতে করে পুকুরপাড় থেকে কাঁচের বোতল নিয়ে আসে। সেই থেকে আতঙ্কে আছি—ওই কাঁচে কী ছিল, কেউ জানে না!”
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শারমিন আহমেদ তিথি জানান—“পুরোনো ডাম্পিং ব্যবস্থা অকেজো হয়ে গেছে। সোনারগাঁ পৌরসভা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। দ্রুত আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু হবে।”
কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, “এসব বলা হচ্ছে অনেক বছর ধরে, বাস্তবে কিছুই হয় না। এখন আর প্রতিশ্রুতি নয়, পদক্ষেপ দরকার।”
স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিদের মতে, পুকুরের পানির মাধ্যমে ছড়াতে পারে, চর্মরোগ (স্ক্যাবি, ফাংগাল ইনফেকশন), চোখের সংক্রমণ (কনজাংটিভাইটিস), হেপাটাইটিস A, B, C, E, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিস, গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে গর্ভে সংক্রমণ ও জন্মগত ত্রুটি সহ অনেক রোগ।
সকলেই মনে করেন এখনই জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোঃ হোসাইন, কিছু পরামর্শ ও দাবি জানিয়ে বলেন, “মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষিত টিম নিয়োগ, নিরাপদ ইনসিনারেটর (দাহক চুল্লি) স্থাপন, পুকুর ঘিরে সুরক্ষা বেষ্টনী নির্মাণ, মুরগী-কুকুরের প্রবেশ বন্ধে ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় বাসিন্দাদের বিকল্প পানি সরবরাহ, পরিবেশ অধিদপ্তরের জরুরি তদন্ত করলে হয়তো সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে যেতো।”
স্বাস্থ্যসেবার পরিবর্তে ভয়াবহ রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। তারা মনে করেন একটি হাসপাতাল চত্বরের এমন বর্জ্যব্যবস্থা যদি এইরকম হয়, তবে তা নিছক অব্যবস্থাপনা নয়, বরং এটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা ও নীতিনৈতিক দায়িত্বহীনতা।