কুমিল্লার কোতয়ালী তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদর দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ
বিশেষ প্রতিবেদক : পুলিশকে জনগণের বন্ধু বলা হলেও, কিছু অসৎ, লোভী ও ঘুষখোর কর্মকর্তার জন্য মানুষ পুলিশকে ভিন্ন চোখে দেখে এবং এর ফলে পুলিশ প্রশাসনের দুর্নাম রটে। তেমনই একজন মামলাবাজ পুলিশ কর্মকর্তা হলেন কুমিল্লা কোতোয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিনুল ইসলাম, যার বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। গত ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ওসি হিসেবে যোগদানের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের ফিরিস্তি নিয়ে ধারাবাহিক তিন পর্বের অনুসন্ধানের এটি প্রথম পর্ব, যা ‘অপরাধ বিচিত্রা’র আজকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
মামলা বাণিজ্য ও হয়রানির অভিযোগ
অভিযোগ উঠেছে, ওসি মহিনুল ইসলাম যোগদানের পর থেকে জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে ব্যাপক ‘মামলা বাণিজ্যে’ জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেতাকর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও ‘আওয়ামী লীগার’ তকমা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও, দায়িত্বে চরম অবহেলাসহ অসংখ্য অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তার এই হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা বাণিজ্য থেকে বাদ যায়নি পেশাদার একজন সাংবাদিকও।
সাংবাদিক শাহীন আলমকে মিথ্যা মামলায় জড়ানোর অভিযোগ
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, পেশাদার সাংবাদিক এম শাহীন আলম নিয়মিতভাবে ঢাকায় বসবাস করেন। অথচ ওসি মহিনুল ইসলামের কারসাজিতে মামলা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাদীকে সুদূর হবিগঞ্জ থেকে ডেকে এনে, গাড়ি ভাড়া ও তিন দিনের হোটেল খরচ দিয়ে, এক চাঞ্চল্যকর মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলাটি ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঘটনার প্রায় ১০ মাস পর দায়ের করা হয়, যেখানে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার হোটেল আল বাইকের কর্মচারী রাফসান নামের এক যুবককে হত্যা করা হয়েছে দাবি করা হয়েছে। এই ভুয়া ও মিথ্যা মামলাটিতে ১৪৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৪১ নম্বর আসামি করা হয়েছে সাংবাদিক এম শাহীন আলমকে। উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে গণহত্যামূলক ঘটনার সময় সাংবাদিক এম শাহীন আলম ঢাকায় ছিলেন।
‘ভুয়া’ হত্যা মামলার বিস্তারিত ও সাবেক ওসির বক্তব্য
শুধু সাংবাদিক এম শাহীন আলমই নন, কুমিল্লার রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি এই মিথ্যা মামলার আসামির তালিকায় রাজমিস্ত্রীসহ খেটে খাওয়া অসংখ্য নিরীহ সাধারণ মানুষকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরেজমিনে অনুসন্ধানে ‘অপরাধ বিচিত্রা’ জানতে পেরেছে যে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কোনো প্রকার হত্যা কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তাহলে ওসি মহিনুল ইসলাম কীভাবে এই হত্যা মামলাটি দায়ের করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৭ জন নিরীহ লোককে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠালেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো প্রশ্ন তুলেছে, যে নিরীহ লোকগুলোকে তিনি মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছেন, তার দায় কি তিনি এড়াতে পারবেন? এই হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলার জন্য ভুক্তভোগীরা বর্তমানে ওসি মহিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে আইনানুগ অভিযোগ দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
এই হত্যা মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে কুমিল্লা কোতোয়ালী মডেল থানায় দায়িত্বে থাকা তৎকালীন ওসি ফিরোজ হোসেন মোবাইল ফোনে ‘অপরাধ বিচিত্রা’কে জানান, “৫ আগস্ট তো বিজয়ের দিন ছিল, সেদিন হত্যা হবে কেন?” তিনি আরও নিশ্চিত করেন যে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কোনো ধরনের হত্যার ঘটনা ঘটেনি।
আইনি প্রশ্ন ও রাজনৈতিক মতাদর্শের অভিযোগ
আইনিভাবে প্রশ্ন হলো, কুমিল্লা কোতোয়ালী মডেল থানার ওসি মহিনুল ইসলাম কিসের ভিত্তিতে রাফসান হত্যা মামলাটি দায়ের করলেন? ৫ আগস্ট তো ছিল জুলাই-আগস্টের বিজয়ের দিন, আনন্দ-উল্লাসের দিন; ওই দিন তো কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কোনো হত্যার ঘটনাই ঘটেনি। প্রশ্ন উঠেছে, ওসি মহিনুল ইসলাম কি হত্যা মামলাটি দায়ের করতে রাফসান হত্যার মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়েছিলেন? মহিনুল ইসলাম যোগদানের আগে যিনি ৫ আগস্টের দিন কুমিল্লা কোতোয়ালী মডেল থানার ওসি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন, সেই সাবেক ওসি ফিরোজ হোসেনের সাথে কি তিনি যোগাযোগ করেছিলেন? নাকি মামলা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে কাউকে তোয়াক্কা করেননি? অনুসন্ধানে জানা যায়, ওসি মহিনুল ইসলামের নিজ জেলা বগুড়া, যা বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিজেকে বিএনপির মতাদর্শী দাবি করে একের পর এক অনিয়ম করে চলেছেন।
অন্যান্য গুরুতর অভিযোগ
এছাড়াও, ওসি মহিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে আরও বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। একজন ভুক্তভোগীর ভাই অপহরণের অভিযোগ করার পর ৬ হাজার টাকা নিয়েও অভিযোগের দায়িত্বে থাকা এসআই শাহামিন বিশ্বাসসহ ওসি মহিনুল ইসলাম ভুক্তভোগীকে উদ্ধারে চরম অবহেলা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
আরেকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক বছর পর এসে চাচার সাথে ভাতিজার বাক-বিতণ্ডার জেরে, চাচা (যাকে সরাসরি আওয়ামী লীগের দোসর এবং ‘২৪ এর আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অর্থ যোগানদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে) শিক্ষা নির্বাহী প্রকৌশলী আলেক হোসেনের সঙ্গে ওসি মহিনুল ইসলামের যোগসাজশে তিনটি মামলা দিয়ে রাসেল নামের এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগী রাসেলের পরিবার।
সর্বোপরি, অভিযোগ রয়েছে, ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে ওসি মহিনুল ইসলাম তথাকথিত ‘সোর্স’ বা থানার দালালদের মাধ্যমে মাদক ও চোরাকারবারি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সাপ্তাহিক ও মাসিক চাঁদা উত্তোলনসহ অসংখ্য অনিয়ম করেন। ‘অপরাধ বিচিত্রা’র অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে এবং এই মাল্টিমিডিয়া ও নিউজের দ্বিতীয় পর্বে আরও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হবে।